শিরোনাম: |
মহামারী করোনা কি মানুষের জন্য পরীক্ষা নাকি অপরাধের শাস্তি? করোনাভাইরাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়?
![]() |
![]() করোনাভাইরাস কি আজাব নাকি ধৈর্য পরীক্ষা? মানুষের ধৈর্য পরীক্ষার জন্য নানান ভয়-ভীতি ও ক্ষয়-ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কুরআনে। আবার মানুষের অপরাধ ও অবাধ্যতার কারণেও আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিপদাপদে নিমজ্জিত করবেন বলে সতর্ক করেছেন কুরআনে। তাহলে মহামারী করোনা কি মানুষের জন্য পরীক্ষা নাকি অপরাধের শাস্তি? করোনাভাইরাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়? মহান আল্লাহ তাআলা নিরাপরাধ। তিনি সব অপরাধ থেকে মুক্ত এবং পবিত্র। মানুষ যেসব রোগ-শোক ভোগ করে তা মানুষের কর্মের পরিণতি। কেননা কোনো মানুষই এ কথা বলতে পারবে না যে, সে অন্যায় অপরাধের উর্ধ্বে। সে কারণেই আল্লাহ মাঝে মাঝে কিছু কিছু জনপদে ভয়-ভীতির উদ্দেশ্যে কিছু রোগ-শোক দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে ইরশাদ করেন- ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-ফসলাদি বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫) আবার অনেক সময় মানুষের অপরাধ প্রবণতা স্রষ্ঠার সঙ্গেই নয় বরং মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায়-অপরাধে মাত্রা অধিক হারে বেড়ে যায়। জুলুম অত্যাচারের মাত্রা এতো অধিক পরিমাণে বেড়ে যায় যে, অত্যাচারিত মানুষ নিরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকে। অত্যাচারিত মানুষের চোখের পানি ও কষ্ট আল্লাহ সহ্য করতে পারেন না। ফলে আল্লাহ তাআলা জমিনে আজাব-গজব নাজিল করতে থাকেন। যা মহামারী আকার ধারণ করে নতুন নতুন রোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে পৃথিবীতে নেমে আসে। যা প্রতিরোধ করা মানুষের অসাধ্য হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা কুরআনের একাধিক আয়াতে এসব বিপদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি ঘোষণা করেছেন। আর তাহলো- >> ‘আর তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ আসে, তা তোমাদের কর্মেরই প্রতিফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। তোমরা পৃথিবীতে আত্মগোপন করে আল্লাহকে অক্ষম করতে পার না এবং আল্লাহ ব্যতিত তোমাদের কোনো কার্যনির্বাহী নেই, সাহায্যকারীও নেই। [ (সুরা শুরা : আয়াত ৩০-৩১) >> মানুষের কৃতকর্মের কারণেই স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (অন্যায় পরিহার করে সঠিক পথে) ফিরে আসে। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১-৪২) >> (হে রাসুল! আপনি) বলুন, কে তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন অথবা তোমাদের প্রতি অনুকম্পার ইচ্ছা করলে কে বঞ্চিত করতে পারে? তারা আল্লাহ ব্যতিত নিজেদের জন্য কোনো অভিভাবক ও সাহায্যারী পাবে না।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ১৭) মহান আল্লাহ তাআলার এ আয়াতগুলোতে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত ব্যাক্তিদের সঠিক পথে ফিরে আসতে সমূহ বিপদ ও ক্ষয়-ক্ষতির হুশিয়ারি হিসেবে নাজিল করেছেন। যারা জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়-অপরাধ থেকে ফিরে আসবে তারা মুক্তি পাবে। আর যারা অপরাধের উপর অটল থাকবে তাদের জন্য এ ক্ষয়-ক্ষতিগুলো মাহমারী আকার ধারণ করবে। আর তখন তা হয়ে যায় বান্দার জন্য আজাব ও গজব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারী। এটি মানুষের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা নয়, এটি নিঃসন্দেহে মানুষের অন্যায়-অপরাধের শাস্তিস্বরূপ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার আজাব ও গজব। এ থেকে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় তার অবাধ্যথাকে থেকে ফিরে থাকা। বিশ্বনবি ঘোষণা করেছেন, ‘যখন কোনা জাতির মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের মধ্যে এমন এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ) মুমিন মুসলমানের জন্য এ মহামারী এক মহা সতর্কবার্তা। আর অপরাধীদের জন্য এক মহা গজব ও আজাব। অববাধ্যতা ও অন্যায়-অপরাধের ফলে মহামারী করোনায় পতিত হয়েছে বিশ্বের ১২৪টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের লাখেরও বেশি মানুষ। মারা গেছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজরেরও বেশি মানুষ। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে অতীতের অনেক জাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যারা নিজেদের ওপর, প্রতিবেশির ওপর কিংবা রাষ্ট্রে অধীনস্তদের ওপর জুলুম করেছে, তারা আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছে। কুরআনের এসব ইতিহাস আল্লাহ তাআলা মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য তুলে ধরেছেন। তারপরও মানুষ কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। আর তা ভুলে অন্যায়, অপরাধ ও জুলুম-অত্যাচারে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। যে কারণে মানুষের ওপর নেমে আসে করোনা-সিডরসহ ভাইরাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সীমাহীন ক্ষয়-ক্ষতি ও শাস্তি। সে কারণেই আল্লাহ তাআলা হুশিয়ারি ঘোষণা করেছেন- ‘এসব জনপদের অধিবাসীরা কি আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত বা নিরাপদ হয়ে গেছে যে, রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের ওপর তার শাস্তি নেমে আসবে না? আর এসব জনপদের অধিবাসীরা কি এ বিষয়েও নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হয়ে গেছে যে, দুপুর বেলায় খেলাধুলায় মত্ত থাকা অবস্থায় তাদের ওপর তার শাস্তি নেমে আসবে না? (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৯-১০০) করোনাভাইরাস মুমিনের জন্য সতর্কতা আর জালিম অত্যাচারীদের জন্য এক মহা গজব। এ গজব থেকে বাঁচতে ইসলামের দিক-নির্দেশনা মেনে চলাই মানুষের জন্য একান্ত প্রয়োজন। করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত সকাল-সন্ধ্যার আমলের পাশাপাশি হাদিসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা জরুরি। আর তাহলো- >> বেশি বেশি ইসতেগফার করা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে থাকতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাওয়া। অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব সময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা- اَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِى لَا اِلَهَ اِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْم উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত সকাল-সন্ধ্যার আমল করা। প্রিয় নবি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিন বার বলবে- بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিসসামায়ি, ওয়া হুয়াসসাম উল আলিম।’ অর্থ : ‘আল্লাহর নামে, যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’ সকাল হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এ দোয়া পড়বে, সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো বিপদ আসবে না।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ) >> اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি) অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানা নেই) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)। >> اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ (তিরমিজি) অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)। বিশেষ করে এ হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা- যে দেশ ও অঞ্চলে মহামারী করোনা ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দেশ ও অঞ্চলে না যাওয়া। আবার যারা সেসব অঞ্চল ও দেশে রয়েছে তারাও নিরাপদ অঞ্চলে না যাওয়া। হাদিসে এসেছে- ‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা বাইরে থাকো তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি, মুসলিম) উল্লেখ্য যে, প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনায় বিশ্বের ১২৪টি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩শ জন আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪ হাজার ৬৩৩ জনের প্রাণ হারিয়েছে। শুধুমাত্র চীনের মূল ভূখণ্ডেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৮০ হাজার ৭৯৬ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬৯ জনের। চীনের পর রয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালি। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৪৬২ জন এবং এতে মৃত্যু হয়েছে ৮২৭ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তাআলা বিশ্বমানবতাকে মহামারী করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত করুন। যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ থেকে নিজেদের বিরত রাখার তাওফিক দান কারুন। আমিন। চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের শতাধিক দেশে। এতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ শেষ পর্যন্ত বিশ্বকে কোন পরিণতিতে ফেলে তা ধারণা করতে পারছেন না কেউই। কিন্তু এটি যে এরই মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে দৈনিক আয়-রোজগারে পর্যন্ত প্রভাব ফেলেছে, তা প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ববাসী। সর্বশেষ বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসে তিনজন সংক্রমিত হওয়ার ঘোষণা এসেছে গত ৮ মার্চ। ফলে ডব্লিউএইচও’র ঘোষিত এ বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেও। আর করোনাভাইরাস সংক্রান্ত খবর কাভার করার ক্ষেত্রে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন দেশের সাংবাদিকরা। নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ভুয়া তথ্য ও গুজবের বিস্তার ইত্যাদি কারণে তাদের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে হয়েছে। এসব বাধা জয় করেই সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। এক্ষেত্রে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি করোনাভাইরাসের মতো মহামারির খবর প্রচারে যেন কোনো ভুল তথ্য না যায় এবং আতঙ্ক না ছড়ায়, সেজন্য মাথায় রাখতে হবে গভীর দায়বোধও। করোনাভাইরাস শুধু নয়, যে কোনো মহামারি কাভারেজে সাংবাদিকরা কীভাবে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৈশ্বিক প্লাটফর্ম জিআইজেএন-এর বাংলা সম্পাদক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী। জিআইজেএন-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেই পরামর্শ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য। সবার আগে নিজের নিরাপত্তা একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য নিজেকে রক্ষার যত রকমের উপায় আছে, তার সবই একজন সাংবাদিকের জন্যেও প্রযোজ্য। পার্থক্য হলো, একজন নাগরিক তার চলাফেরা ঘরে বা নিরাপদ স্থানে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। কিন্তু একজন সাংবাদিককে পেশার প্রয়োজনেই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেতে হয়। করোনাভাইরাসের খবরও সংগ্রহ করতে হবে, কিন্তু মাথায় রাখবেন, তা নিজের নিরাপত্তাকে বাদ দিয়ে নয়। আক্রান্ত এলাকায় গেলে- সর্দি, কাশি বা শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভুগছেন, এমন মানুষের কাছাকাছি যাবেন না। নিজে হাঁচি–কাশি দেয়ার সময় হাত দিয়ে নাক ও মুখ ঢেকে রাখবেন। গরম পানি ও সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। সাবান বা গরম পানি না পেলে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী জেল বা ওয়াইপস ব্যবহার করুন। কিন্তু তারপর যত দ্রুত সম্ভব গরম পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। হাসপাতাল বা আক্রান্ত স্থানে খবর সংগ্রহে গেলে হাতে দস্তানা পরে নিন। মাথায় রাখুন, এসব জায়গায় বডিস্যুট ও ফেসমাস্কের মতো পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দরকার হতে পারে। আক্রান্ত এলাকার কাঁচা–বাজার বা খামারে যাবেন না। জীবিত হোক বা মৃত – পশু–পাখির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই প্রাণির সংস্পর্শে এসেছে এমন দেয়াল বা কোনো কিছুতে হাত দেবেন না। যদি আক্রান্ত বাজার বা খামারে যেতেই হয়, তাহলে আপনার কোনো যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামই মাটিতে রাখবেন না। ফিরে এসে ব্যাকটিরিয়া প্রতিরোধী জেল (মেলিসেপ্টল) বা ওয়াইপস দিয়ে পরিষ্কার করে নিন। আক্রান্ত এলাকার বাজারে যেতে হলে, ডিসপোজেবল অথবা পানি–নিরোধী জুতো পরে যান। ঘটনাস্থল থেকে বেরুনোর পরপরই তা ধুয়ে–মুছে নিন এবং কাজ শেষ হলে তা ফেলে দিন। আক্রান্ত এলাকায় বা সেখানে কোনো পশুপাখির পাশে দাঁড়িয়ে কিছু খাবেন না, অথবা পান করবেন না। আপনার নিজেরই শ্বাসকষ্টসহ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে কী করবেন, তা আগেই ভেবে রাখুন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের নীতিমালা (অনেকখানেই যেমন সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনের কথা বলা হয়) মেনে চলুন। আক্রান্ত এলাকা থেকে ফেরার ১৪ দিনের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং আপনার অফিসকে জানান। আতঙ্ক ছড়াবেন না গত ১২ জানুয়ারি থেকে টানা এক মাস করোনাভাইরাস বিষয়ক প্রায় সাড়ে ৯ হাজার খবর বিশ্লেষণ করেছেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক কারিন ওয়াল–জোরগেনসেন। তার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ১১শ খবরে ‘ভয়’ অথবা ‘ভীত’ শব্দটি এসেছে। অন্তত ৫০টি রিপোর্টে রোগের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘কিলার ভাইরাস’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মতে, মহামারির খবর দিতে গিয়ে গণমাধ্যম অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক ছড়ায়। জোরগেনসেনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, কীভাবে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো প্রতিদিন ‘প্রাণঘাতী রোগ’ বলে ভয়টাকে বাড়িয়ে তুলছে; করোনাভাইরাসে ব্যবসার বিপর্যয় নিয়ে শিরোনাম কী প্রভাব ফেলছে; করোনাভাইরাস বোঝাতে শুধু মাস্ক পরা চীনাদের ছবি ছাপিয়ে কীভাবে এশীয়দের প্রতি ভীতি বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। আতঙ্ক না ছড়িয়ে রিপোর্টিংয়ের উপায় কী? এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন পয়েন্টার নিউজ ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফ্যাকাল্টি অ্যাল টম্পকিনস। তার মতে, একমাত্র সমাধান হলো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা। এর কিছুটা যেমন- প্রতিবেদনে বিশেষণের ব্যবহার কমান, যেমন- ‘প্রাণঘাতী’ ভাইরাস। ছবি ব্যবহার করুন সতর্কতার সাথে, যেন তা ভুল বার্তা না ছড়ায়। প্রতিবেদনে ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরুন। শুধু ভয়াবহতার কথা না বলে, এমন পরিস্থিতিতে কী করতে পারে, সেই পরামর্শও দিন। ব্যক্তি–অভিজ্ঞতার ভয় জাগানো বিবরণের চেয়ে পরিসংখ্যান–নির্ভর স্টোরি কম ভীতিকর। মনে রাখবেন, ভাইরাসের বিস্তার একটি প্রাকৃতিক বিষয়। বিশ্বে এর চেয়ে ভয়ংকর আরও অনেক বিষয় আছে। এই বিষয় নিয়ে যত মিথ বা ভ্রান্ত জনশ্রুতি তৈরি হয়েছে – ভেঙে দিন। ক্লিকবেইট হেডলাইন পরিহার করুন এবং রিপোর্ট উপস্থাপনে সৃজনশীল হোন। সাংবাদিক ক্যারোলিন চেন কাজ করছেন মার্কিন গণমাধ্যম প্রো–পাবলিকায়। তিনি সার্স এবং ইবোলা ভাইরাস বিস্তারের ঘটনা সামনে থেকে কাভার করেছেন। তার পরামর্শ- চারিদিকে গুজব, যাচাই করে নিন রসুন খেলে করোনাভাইরাস মরে যায়, কোনো গোপন পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, একটি কোম্পানি ভ্যাকসিন বানিয়ে ফেলেছে, হোমিওপ্যাথি কোভিড–১৯ সারায়, গরমকালে এই ভাইরাস থাকবে না – এমন অনেক খবর নিশ্চয়ই আপনাদের নজরে পড়েছে। যে কোনো মহামারিতে এই ধরনের ভুয়া খবর বা মিথ্যা তথ্যে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে যায়। এবারও ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় দেখা যায়, অখ্যাত উৎস থেকে নিয়ে যাচাই ছাড়াই এমন খবর প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমও প্রকাশ করে দিচ্ছে। এতে পাঠকরা যেমন বিভ্রান্ত হন, তেমনি কখনো কখনো আতঙ্কও ছড়ায় জনমনে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের নিজেদের সাইটে এমন অনেক মিথ ও গুজব খন্ডন করেছে। যতদিন মহামারি থাকবে ততদিনই এমন সব গুজব ও ভুয়া খবর কমবেশি সামনে আসবে। তাই গুজব যাচাই করে নিন। নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে যত ভুয়া খবর আসছে, তার সত্য–মিথ্যা যাচাই করে, নিজেদের সাইটে প্রকাশ করছে এএফপি। সেখান থেকেও অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্কের অধীনে ৯০টি প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য যাচাই করছে। করোনাভাইরাস নিয়ে ভুয়া খবর বিশ্বাস করে সরকার বা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা যেসব মন্তব্য করেছেন তা খন্ডন করে আসছে পলিটিফ্যাক্ট। ভারতে অল্টনিউজ, বুম লাইভ অথবা বাংলাদেশে বিডিফ্যাক্টচেকের মত সাইটে গেলেও কোভিড–১৯ নিয়ে নানা রকমের ভুয়া খবরের খন্ডন দেখতে পাবেন। মহামারির সময়ে আতঙ্ককে পুঁজি করে প্রতারকরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের সাইটে এমন প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। কোথায় পাবেন সঠিক তথ্য কোথাও ভাইরাসটিকে বলা হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস, কোথাও নিউ করোনাভাইরাস, কোথাও আবার দ্য করোনাভাইরাস। এত নাম কেন? কোভিড–১৯ নামটিই বা কোথা থেকে এসেছে? আপনি ভাইরাসটিকে আসলে কী নামে ডাকবেন, অথবা ভাষার ব্যবহার কেমন হবে – এসবই উঠে এসেছে কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। সিপিজে বলেছে, সব সময় হালনাগাদ থাকতে হলে, আপনাকে অবশ্যই এই তিনটি সাইটে নিয়মিত যেতে হবে: ডব্লিউএইচও, সিডিসি এবং পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড। সেই সাথে নিজ দেশে সরকারের যে সংস্থাটি করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। যেমন: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। জার্নালিস্টস টুল বক্সে সাংবাদিক মাইক রাইলি তথ্যের এমন আরও কিছু উৎসের সন্ধান দিয়েছেন। যেমন- জনস হপকিন্স করোনাভাইরাস মানচিত্র গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স ওয়ার্ল্ডোমিটার: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ডেটা স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা বিভাগ: করোনাভাইরাস বিএনও নিউজ: ট্র্যাকিং করোনাভাইরাস – মানচিত্র, ডেটা এবং টাইমলাইন দ্য নিউজমার্কেট: ভিডিও ও বি–রোল টুইটারে করোনাভাইরাস এমপাসপোর্ট.কম (চার হাজার ডাক্তারের ডেটাবেস) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগতত্ত্ব বিভাগের দুই অধ্যাপক বিল হানাগে এবং মার্ক লিপসিচ সাংবাদিকদের জন্য পাঁচটি পরামর্শ তুলে ধরেছেন আমেরিকান সায়েন্টিফিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, যার শিরোনাম ‘কোভিড–১৯ রোগের বিস্তার দায়িত্বশীলতার সাথে কাভার করবেন কীভাবে।’তার সারমর্ম- বিশেষজ্ঞ বাছাই করুন সতর্কতার সাথে। বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে কেউ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মানে এই নয়, তিনি বিজ্ঞানের সব বিষয়ে বলতে পারবেন। একইভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রে কেউ পিএইচডি করলেও করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানবেন এমন কোনো কথা নেই। বিশেষজ্ঞরা কোনটি সত্য নিশ্চিতভাবে জানেন আর কোনটি সত্য বলে মনে করেন – তার মধ্যকার ফারাকটা অবশ্যই বুঝতে হবে একজন সাংবাদিকের। জানতে হবে মতামত ও অনুমানের মধ্যে পার্থক্য। প্রি-প্রিন্ট অথবা অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে উদ্বৃতি অথবা তথ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক হোন। এ ধরনের একাডেমিক পেপার সাধারণত পর্যালোচনা বা পিয়ার রিভিউর মধ্যে দিয়ে যায় না। তাই ভুলের অবকাশ থাকে। নানান নতুন তত্ত্ব এবং দাবির মধ্যে সংবাদ উপযোগী কিছু আছে কি-না, তা বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করুন। পত্রিকার মতামত পাতায় প্রকাশিত তথ্যও যাচাই করুন। বিজ্ঞান বিষয়ে অন্য সাংবাদিকরা কী কী রিপোর্ট করেছেন বা করছেন তা নিয়মিত পড়ুন। দরকারি রিসোর্স ভাইরাসের বিস্তার বিশ্বের জন্য নতুন কিছু নয়। বার্ড ফ্লু, সার্স অথবা মার্স – প্রতিটি ঘটনায় কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব, হারিয়েছে অনেক প্রাণ। আর এসব ঘটনায় সাংবাদিকরাও শিখেছেন কীভাবে মহামারি কাভার করতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ডার্ট সেন্টার ফর ট্রমা এমন কিছু রিসোর্সের একটি সংকলন তৈরি করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু কাভারের শিক্ষা থেকে সাংবাদিক জন পোপের টিপশিট। ট্র্যাজেডি ও সাংবাদিকতা – সাংবাদিক ও সম্পাদকদের জন্য গাইড ট্রমা রিপোর্টিংয়ের উত্তম চর্চা দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে কীভাবে কাজ করবেন আক্রান্তদের প্রতি সদয় হোন করোনাভাইরাসের খবরাখবর জানাতে গিয়ে সাংবাদিকরা যেমন বিশেষজ্ঞের পেছনে ছুটছেন তেমনি আক্রান্তদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। তবে আক্রান্তদের কথা বলতে গিয়ে আপনি তাকে আরও বিপদে ফেলছেন কি-না, তা মাথায় রাখতে হবে। কারণ আপনার রিপোর্ট প্রকাশের পর হয়ত আক্রান্তের কিংবা তার পরিবারের সমাজে চলাচল বিঘ্নিত হতে পারে। অথবা তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন। ফলে আপনার রিপোর্টে আক্রান্তের বা সন্দেহভাজনের ছবি দেখানো কিংবা তার পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাবধানী হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে যার পরিচয় দেবেন তার অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। ট্রমা আক্রান্ত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন, পড়ে নিতে পারেন সেন্টার ফর হেলথ জার্নালিজম থেকে। আপনি হয়তো একটি রিপোর্ট করলেন, জানালেন – কিন্তু আপনার রিপোর্টের কারণে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতি হয় তার দায়ভারও আপনারই। দায়িত্বশীল কাভারেজ কীভাবে আতঙ্ক না ছড়িয়ে দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে খবরটি মানুষের কাছে পৌঁছাবেন তা ঠিক করে নিতে হবে আপনাকে ও আপনার নিউজরুমকে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আইজেনেটের ১০টি পরামর্শ- মাঠের মেজাজ বুঝে তা আপনার রিপোর্টে তুলে ধরুন। রিপোর্টিংয়ে মনোযোগ দিন, বিশ্লেষণে নয়। শিরোনাম খেয়াল করুন, কারণ অনেক পাঠক শুধু শিরোনাম দেখেই সিদ্ধান্ত নেন। মনে রাখবেন সব পরিসংখ্যান সঠিক না–ও হতে পারে। যত বেশি মানুষের সাথে কথা বলবেন, তত ভালো। জাতি বা বর্ণ বিদ্বেষ তৈরি করে এমন বাক্য পরিহার করুন। বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে যথার্থ প্রস্তুতি নিন। চমক নেই বলে, কোনো স্টোরিকে অবজ্ঞা করবেন না। নিজের সীমা ঠিক করুন, সময় নিয়ে ভাবুন। রোগ চলে গেলেও আপনার রিপোর্টিং থামাবেন না। |