শিরোনাম: |
বর্ষা-বরণ: এ কে সরকার শাওন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ৭১ সংবাদ ডট কম :
|
সৃষ্টি, জাগরণ, পূণঃজাগরণ, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য, গান, কবিতা, সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্যের ঋতু বর্ষাকাল। বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদগণ বর্ষাকালকে চিহ্নিত করেছেন ‘দ্বিতীয় গ্রীষ্মকাল’ হিসেবে। এ সময়ে বেশ গরম থাকলেও বৃষ্টির শীতল পরশ বুলিয়ে সবার তনু মনে প্রশান্তির প্রলেপ এনে দেয় অনবরত। সেদিন কানিজ বলেছিল উত্তরখান বাজার থেকে আধা মন আম কিনে আনতে। জগলু মুখে মাস্ক, হাতে গ্লোবস, চোখে গগলস, পায়ে কেডস, গায়ে রেইন কোটের মত পিপিই পরিধান করে মানে রণসাজে আম কিনিবার অভিযানে প্রধান ফটক খুলিবার সময় কানিজ নিজেই বাঁধা দিয়ে বললো, না, যেয়ো না, আমার আম লাগবে না! আম খাবে না? জগলু প্রশ্ন ছুড়ল। সে আরও বলেছিলো তুমি আম খেতে চেয়েছো; এই জগলু সরকার আম কিনে আনবে না এমনটি হতেই পারে না! যেখান থেকে পারি যেমন করে পারি আম আমি কিনে এনেই ছাড়বে ইনশাআল্লাহ! সেটা রতনপুর হোক, রাজশাহী হোক আর রাশিয়াই হোক! কানিজ বললো না, লাগবে না! আমার আম লাগবে না! রিস্ক নিয়ে আম কেনার দরকার নাই। তবে রাজশাহী থেকে আনা যায় কি-না চেষ্টা করতে পারো! আমি তখন চৌদ্দ এন্ট্রির বন্ধু আরমান নিখলীর রাজশাহী থেকে আম কেনার বাস্তব কাহিনীর সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরলাম। রাজশাহী থেকে ঢাকা আসতে আসতে পঁচতে পঁচতে পঞ্চাশভাগ আম পঁচে গিয়েছিল। বাকী ২০ কেজি আধাপঁচা আম সবগুলি দুই এক দিনের মধ্যে খেয়ে শেষ করতে হবে! তা না হলে সেগুলিও পঁচার খাতে চলে যাবে। থাক, থাক, এবার আমেরই দরকার নাই। বলেই কানিজ তার স্কুলের কাজে মনোনিবেশ করলো! বাড়ীতে ধন্যি মেয়ে তৃষা ও তুরণা মা মনি নাই। নাই ফলের সমারোহ! আনন্দ, উৎসব, পার্বণ সব শিকেয় উঠেছে! এবারের গ্রীষ্মকালটাও করোনার অভিশাপে ম্লান। এখনো শেষ হতে নাকি দুই দিন বাকী। এতো লম্বা গ্রীষ্মকাল সে তার সারা জীবনে দেখে নাই!মনের শত শত দুঃখ চেপেই ঘুমাতে গেলো জগলু ! ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা দু’দিকে সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ মুখ ভার করে বসে আছে। যেন এখুনি ঝুপ ঝুপ করে ঝড়ে পড়বে। বর্ষাকাল আসার আগেই বৃষ্টির এতো আনাগোনা ভালভাবে নিচ্ছে না জগলু! বিয়ের আগে যেমন বর কনের মেলামেশা আভিভাবকগন ভালভাবে মেনে নেন না অনেকটা সেই রকম। আরে বাপু একটু তো সবুর কর। কেউ তোমাকে বরণ না করলেও উদীচী ও জগলুরা তো বরণ করতে মুখিয়েই বসে আছে! যে যাকে বেশী ভালবাসে তাকে সে তাকে তত সম্মানীত করতে চায়! গজলু বর্ষাকালকে খুবই ভালোবাসে। পুরো পৃথিবী গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড উত্তাপে নাজুক থাকবে ইংরেজিতে যাকে বলে স্কর্চিং হিট অব সামার ( Chorching Heat of Summer). সবাই এসো হে বৃষ্টি এসো ধরায় গান গেয়ে, কবিতা পড়ে অস্থির হবে তখন বীরের বেশে ত্রাণকর্তা হিসেবে আভির্ভূত হবে প্রিয় বর্ষাকাল। এবার পরপরই বিরতি দিয়ে দিয়ে বৃষ্টি আসায় বর্ষাবরনের গুরুত্ব কমে গিয়েছে। বাংলাদেশে বর্ষার আবেদন বহুর্মুখী! বর্ষা রূপময়, কাব্যময়, প্রেমময়ও বিষাদময় ইত্যাদি। বর্ষা অতি আকর্ষণীয় ঋতু। প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিকদের মনে সে স্থায়ী আসন পেতে রানীর মতো বসে আছে। সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতা, গানে, গজলে, কথা-কাব্যে, বর্ষা-বন্দনা অনেক হয়েছে। বর্ষা-বৃষ্টি-কবিতা-প্রেম-বিরহ-সংগীত একটির সাথে অপরটি সম্পর্কযুক্ত যা অবিছেদ্য । জগলু মনে করে বর্ষার ভাবনা থেকে অনেকেই কবি হয়েছে। তাই এমন কোনও কবি পাওয়া দুষ্কর যিনি বর্ষাকে কেন্দ্র করে দু’চার লাইন লিখেন নাই। আসলে বর্ষার রূপটা এমনই আকর্ষনীয় যে সে কোনও মানুষকেই সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। রিমঝিম ছন্দের যাদুকরী তালে কবি নজরুলের “বাদলের পরী” বর্ষা আসে ধরাতলে ধরনীকে ভালবেসে নতুন করে সাজাতে ও নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে! মানব-মানবী, ফুল-পাখী-বৃক্ষ-তরু-লতা, চাতক-চাতকী, তৃষিত-প্রেমার্ত হৃদয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-দিঘী, মাঠ-ঘাট, মরু-প্রান্তর, মাছ-ঘাস সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে এই বর্ষার জন্য! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষভাবে জয়গান গেয়ে বর্ষাকে বরণ করেছেন গানে গানে। “এসো শ্যামল সুন্দর, আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে ॥ তিনি অন্যভাবেও বর্ষাকে বরণ করেছেন, “বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি । শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে ঊর্ধমুখে নরনারী॥” জগলুদের অনন্ত ভালোলাগার প্রিয় বর্ষাকালকে ধরাতে আসার আহবান জানিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “এসো হে সজল শ্যাম-ঘন দেয়া বেণু-কুঞ্জ-ছায়ায় এসো তাল-তমাল বনে এসো শ্যামল ফুটাইয়া যূথী কুন্দ নীপ কেয়া॥” তিনি বর্ষায় তাঁর প্রিয়া অঞ্জনাকে কানে অর্জুন মঞ্জরি ও গলায় কদম ফুলের মালা পরে রেবা-নদীর তীরে অভিসারে আসতে মিনতি করেছেন। “স্নিগ্ধশ্যাম বেনীবর্ণ এসো মালবিকা/ অর্জুন মঞ্জুরী কর্ণে গলে নীপ মালিকা।” গীষ্মের কাঠফাটা রোদে মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন গীতিকবি সলিল চৌধুরীর বর্ষাকে চরম কাকুতি মিনতি ও ধান মেপে দিবেন শর্তে আসতে অনুরোধ করে লিখেছেন, আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দিব মেপে! সাবেক কৃষি মন্ত্রী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তাঁর কবিতায় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে কবিতায় যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অসাধারণ! গ্রীষ্মের প্রকোপে চৌচির মাটির বন্ধ্যা কৃষকের কান্না শুনতে পেয়ে তিনি বৃষ্টি ও বর্ষার নিকট “‘বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ কবিতায় নিম্নোক্ত প্রার্থনা করে গেছেন! ‘আমি সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা করেছি বর্ণ এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছি শস্য এবং গাভীর জন্য প্রার্থনা করেছি আমি ভূমি এবং কৃষকের জন্য প্রার্থনা করেছি। বর্ষাকে জগ্লু নিজে অসম্ভব ভালবাসে। অঝরে বর্ষা ঝরা মানে প্রিয়ার চোখের কাজল ধোওয়া জল যা অবিরল ধারায় ঝরে পরলে তার বুকটা বিদীর্ণ হয়ে যায়। নদী-সাগর তাঁর অশ্রুতে কালো হয়ে যায়। আকাশে মেঘের রঙ পরিবর্তন হলে তার মন মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ও বর্ষাকে ডেকেছে কয়েকটি কবিতায়। যেমন “বর্ষা-বরণ” কবিতায় সে লিখেছে... “গ্রীস্মের তীব্র তাপদহে প্রাণ আর বাঁচেনা! সহে না এ যাতনা! বর্ষারাজ, কোথা তুমি? মেঘের ছাতা নিয়ে, তাড়াতাড়ি এসো না!” আল্লাহকে ডাকার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বেশি বর্ষা-বৃষ্টি কে ডেকেছেন মরহুম শিল্পী আব্বাস ঊদ্দিন তাঁর একটি কালজয়ী গানের মাধ্যমে। গানটির প্রথম দু’লাইন নিম্নরুপ। “বেলা দ্বি-প্রহর, ধু-ধু বালূচর ধূপেতে কলিজা ফাটে পিয়াসে কাতর…” মাঝখানের লাইনেগুলির সাথে ছোট বড় সবাই পরিচিত। ছোটবেলা দেখতাম যখন বৃষ্টির জন্য সবখানে হাহাকার তখন একদল নারী-পুরুষ-ছোকড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে শরীরে কাদা-জল মেখে সমস্বরে গাইছে “আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে,পানি দে, ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।” কালজয়ী এ গানটি লিখেছেন শ্রীমান গিরেন চক্রবর্তী মতান্তরে জালালুদ্দিন! বর্ষার আসার পর খুশীতে কবিগুরু চিত্ত চাঞ্চল্য প্রকাশ করে লিখেছেন, “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…” মানব সন্তানগণ মাছদের কথা কখন ও ভাবে না। ডোবা, নালা, পুকুর সেঁচার পর মাছদের দিন কাটে বহু কষ্টে। ওরা সারাক্ষণ মণে প্রাণে বর্ষাকে ডাকে। মাছেরা যারপরনাই খুশি হয় বর্ষার আগমনে। পুঁছ নেড়ে নেড়ে বর্ষাকে স্বাগত জানায়। যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “জীবন স্মৃতি” কবিতায় অতি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। “মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে, এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।” শাওনাজের নাজ সার্কেল এ দূর্বা ঘাসকে ভা্কেবেসে জগলু লক্ষ করেছে সামান্য দূর্বাঘাসও বর্ষার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনে! অতঃপর বৃষ্টি আসার পর ওরা উৎসবে মেতে উঠে! জগলুর ভাষায় “বৃষ্টির আলিঙ্গনে মাতে খরায় তাতানো ঘাস! বর্ষার উৎসবে মজে ছড়ায় প্রেমের নির্যাস!” বর্ষার প্রথম দিন রবি ঠাকুরের প্রকৃতি পর্বের যে গানটি শুনে হাজার হাজার জগলু কদম ফুল হাতে নিয়ে প্রেয়সীকে ইনিয়ে বিনিয়ে মিনমিনিয়ে নীচের গানটি শোনাতে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আহ্বান রইলো লক-ডাউনে বাড়ী থেকে বের না হতে। একান্তই যদি কেউ বের হন, কদম ফুলটি ধরা হাতটি্যেন গ্লোবস পরিহিত থাকে। আর মুখে থাকে জীবন সুরক্ষাকারী মেডিকেটেড মাস্ক! “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবনের গান।”
|