শিরোনাম: |
মার্কিন বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল পরিবেশ চায় : ব্রেন্ডন লিঞ্চ
কালের কণ্ঠ
|
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার কাঠামো চুক্তির (টিকফা) আওতায় আজ ঢাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকে বসছে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে দেশের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ করে আসছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখন অবস্থান কী? সাক্ষাৎকারব্রেন্ডন লিঞ্চ : বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক পণ্যের অনেক চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রে। এখনো বাংলাদেশকে নির্ভরযোগ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এমনকি কভিড-১৯ মহামারির সময়ও এটি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক সরবরাহকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলে আসছে, এ দেশে শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তা স্বীকার করে। যুক্তরাষ্ট্র কি এখন তার বাজারে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার সুবিধা (জিএসপি) ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত? ব্রেন্ডন লিঞ্চ : কর্মীদের অধিকারের ঘাটতি ও অনিরাপদ কাজের পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে জিএসপি কর্মসূচির জন্য যোগ্যতা হারিয়েছিল। বিভিন্ন দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে জিএসপি কর্মসূচি ছিল তার মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। আমরা এখন কংগ্রেসে জিএসপি কর্মসূচি আবারও অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষায় আছি। ১০ বছর আগে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর কর্মীদের নিরাপত্তা মানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যে উন্নতি করেছে তার প্রশংসা আমরাও করি। তবে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রম অধিকারে এখনো ঘাটতি আছে। বিশেষ করে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ও সম্মিলিতভাবে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার কাঠামো চুক্তির (টিকফা) কাউন্সিলে এবং আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কে শ্রমিকদের অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অন্যতম সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট জটিলতাগুলো দূর করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগগুলোর আমরা প্রশংসা করি। আমরা দেখছি, এ ক্ষেত্রে কাজ চলছে। টিকফা কাউন্সিলের বৈঠকে আমরা শ্রমিক ও তাদের সংগঠকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলার পাশাপাশি সংগঠনবিরোধী বৈষম্য ও অন্যান্য অন্যায্য শ্রমচর্চা দূর করার ওপরও জোর দিচ্ছি। বকেয়া বেতনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সম্প্রতি শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে এখনো সংগঠক ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে শ্রম ও শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকার পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়ার সঙ্গে কি রাজনৈতিক বিষয় জড়িত? এর সঙ্গে কি গণতন্ত্র, নৈতিক নেতৃত্ব ও মানবাধিকারের সম্পর্ক আছে? ব্রেন্ডন লিঞ্চ : শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনসম্মত কর্তৃপক্ষ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধাবিষয়ক কর্মসূচি চালুর কোনো আইনি সামর্থ্য নেই। এলডিসি উত্তরণের পর বেশ কিছু বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা কমে যাবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারকে শক্তিশালী রাখতে যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে? ব্রেন্ডন লিঞ্চ : ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বাংলাদেশের সম্ভাব্য উত্তরণে ইঙ্গিত মেলে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নতি করেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক খবর। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরো সংস্কার করতে হবে। এলডিসি উত্তরণের পরও বাংলাদেশ যাতে প্রতিযোগিতামূলক থাকে, তা নিশ্চিত করার একটি উপায় হলো বাংলাদেশের শ্রম আইন সংস্কার, বিশেষ করে সংগঠনের স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষি এবং অন্যায্য শ্রম অনুশীলনের দিকে মনোনিবেশ করা। বাংলাদেশের শ্রম আইনকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি কর্মসূচির যোগ্যতার মানদণ্ড পূরণে সহায়ক হতে পারে। এলডিসি উত্তরণের পরও বাংলাদেশ সমর্থন ও সহযোগিতা হারাবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অংশীদার হিসেবে দেখে। সংস্কার অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এলডিসি উত্তরণের পরও বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত ২০২৩ সালের বিনিয়োগ পরিবেশবিষয়ক বিবৃতির বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলো কোথায় বিনিয়োগ করবে তা বিবেচনার ক্ষেত্রে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও নিরাপদ পরিবেশ খুব জরুরি। কম্পানিগুলো যদি মনে করে, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। যে দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে, সেই দেশগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা কম—মার্কিন নাগরিক ও বিনিয়োগকারীদের যদি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করা যায় তবে বাংলাদেশ আরো বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে। বাংলাদেশে কি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো বাধা আছে? বাংলাদেশের নিশ্চিত করা উচিত যে তার একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো আছে এবং ওই কাঠামো নিরপেক্ষ ও ন্যায্য। বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা উচিত। এগুলো সুষ্ঠু বিনিয়োগের পরিবেশকে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশে ব্যবসা আছে এমন মার্কিন কম্পানিগুলোর কাছ থেকে একটি চ্যালেঞ্জের কথা আমরা শুনি। আর তা হলো বকেয়া পরিশোধসহ ব্যবসা ও চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধগুলো যদি বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ে, তবে সেগুলোর সমাধান হতে কয়েক বছর লাগতে পারে। এই দেরির ঘটনাগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশের ধারণাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। মার্কিন কম্পানিগুলো যাতে অভিযোগ ও মামলা ন্যায্য, ন্যায়সংগত ও দক্ষ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে পারে, সে জন্য আমরা বাংলাদেশকে বিচারব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দিই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বছর সমৃদ্ধির জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামো (আইপিইএফ) চালু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে ওই ফোরামে চায়? ওই ফোরামে গেলে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? ব্রেন্ডন লিঞ্চ : আমরা আনন্দিত যে ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামো (আইপিইএফ) প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী অংশীদার ও বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীকে নিয়ে চালু করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ফলাফল দেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করছি। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট বলেছে, নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার দায়িত্বশীল ব্যাবসায়িক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী (রেসপন্সিবিল বিজনেস কন্ডাক্ট, সংক্ষেপে আরবিসি) কোনো প্রবিধান প্রণয়ন করেনি বা এ বিষয়ে কোনো নিয়ম নির্ধারণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এই আরবিসি বাংলাদেশের জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ? ব্রেন্ডন লিঞ্চ : ২০১৩ সালে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শক্তিশালী করপোরেট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং টেকসই ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ অনুশীলনসহ দায়িত্বশীল ব্যাবসায়িক আচরণের বিষয়ে জোরালো পরামর্শ দিচ্ছে। কারণ এ বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগামী দিনগুলোর পূর্বাভাস পাওয়া যায়, এমন স্বচ্ছ সরকারি নীতিও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আকর্ষণের চাবিকাঠি। |