শিরোনাম: |
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরো সংবেদনশীল হতে হবে-- ড. আতিউর রহমান
|
![]() প্রবৃদ্ধিরদৌড়ে এখনো বাংলাদেশএগিয়েই আছে।তা ছাড়া সমৃদ্ধবাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়েও খুববেশি দ্বিমত নেই। কিন্তুগোল বেঁধেছে সমকালীনসামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে। সামনেবিপুল নীল সমুদ্র। তাকেপাড়ি দেওয়ার সক্ষমতাআগামী দিনের বাংলাদেশের নিশ্চয়ইআছে। কিন্তুবিরাট যেসব ঢেউ এইমুহূর্তে তীরে এসে ধাক্কামারছে তাতেই শঙ্কা বাড়ছে। অথচবাংলাদেশের অর্জন তো মোটেওহেলাফেলার নয়। কিন্তু তবু কেনএই শঙ্কা? এইদুর্ভাবনা কি খুবইসাময়িক? নাকি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ারমতো কোনো বাস্তবকারণ রয়েছে? আমাদেরঅর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের দিকেকী আমরা যথেষ্টনজর দিইনি? নাকিবিশ্ব অর্থনৈতিক চাপের মুখেআমরা খানিকটা অগোছালোপদক্ষেপ নিয়েছি? বাজারের মুডবুঝে কি আমরাযথেষ্ট বিচক্ষণ নীতি-সক্রিয়তাদেখাতে দ্বিধান্বিত? একথা ঠিক, শুধুবাইরের অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ীকরে আমরা আমাদেরএগিয়ে চলার পথ কণ্টকমুক্তরাখতে পারব না। আমাদেরও যে দায়আছে সে কথাটিমানতে হবে।রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কালান্তর’ পর্বেরলেখা ‘বাতায়নিকের পত্র’-এঠিকই অনুভব করেছিলেনযে ‘জাহাজের খোলেরভেতরটায় যখন জলবোঝাই হয়েছে তখনই জাহাজেরবাইরেকার জলের মার সাংঘাতিকহয়ে ওঠে। ভেতরকার জলটা তেমনদৃশ্যমান নয়, তারচালচলন তেমন প্রচণ্ড নয়, সে মারে ভারেরদ্বারা, আঘাতের দ্বারা নয়, এই জন্য বাইরেরঢেউয়ের চড়-চাপড়েরওপরেই দোষারোপ করে তৃপ্তিলাভ করা যেতেপারে; কিন্তু হয় মরতেহবে, নয় একদিনএই সুবুদ্ধি মাথায়আসবে যে আসলমরণ ঐ ভেতরকারজলের মধ্যে, ওটাকেযত শীঘ্রই পারাযায় সেচে ফেলতেহবে। ...মনেরাখা চাই যেসমুদ্র সেচে ফেলা সহজনয়, তার চেয়েসহজ, খোলের জলসেচে ফেলা।’ নিঃসন্দেহে আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তিরউৎস যদি কোনোঘাটতি দেখা দিয়ে থাকেসেদিকে আগে নজরদিতে হবে। আমাদেরঅর্থনীতিতে এখনো নিশ্চয়ই বাইরেরবাধা প্রচুর রয়েগেছে। জ্বালানিতেলের দাম বাড়ছে। ডলারবাজারে আগুন।আমদানি করা পণ্যেরদাম আকাশছোঁয়া।তাই বলে কিহাত গুটিয়ে বসেথাকব? আমাদের মূল্যস্ফীতি, বিশেষকরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিকেবাগে আনার পরিচিতকামান কি আসলেইআমরা সজোরে দাগিয়েছি? সমন্বিত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিরতীর কি সময়মতোতূণ থেকে বেরকরেছি? মুদ্রার একাধিক বিনিময়হারকে কি সমন্বিতকরেছি? শ্রীলঙ্কা এবং হালেরতুরস্ক যদি নীতিসুদের হার এতটাবাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পথে হাঁটারসাহস দেখাতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারছিনা? এসব প্রশ্নেরসোজা উত্তর দেওয়ামুশকিল। এরসঙ্গে অনেক কাঠামোগত প্রশ্ননিশ্চয়ই জড়িয়ে আছে। এ কথাওমানি, নির্বাচনের এই বছরেঅনেক ভেবেচিন্তেই পদক্ষেপনিতে হচ্ছে।তবু মূল্যস্ফীতি ওডলার সংকটের মতোপ্রধান সমস্যাগুলোর সামনাসামনি দাঁড়াতেই হবেআমাদের। অস্বীকারকরার উপায় নেইযে এই মুহূর্তেবিদেশি মুদ্রার বাজারটিই আমাদেরবেশি ভোগাচ্ছে।আবার এর সঙ্গেগভীর সম্পর্ক আছেমুদ্রানীতির ভঙ্গিটির সঙ্গে।অন্য কথায় সুদেরহারের নমনীয়তার মাত্রার ওপর। কভিডসংকট ও ইউক্রেনেযুদ্ধের কারণে আমাদের আমদানিমূল্য বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এইমূল্য শুধুই রপ্তানি ওপ্রবাস আয় দিয়েপুরোপুরি শোধ করাসম্ভব হয়নি বলেই বাণিজ্যঘাটতির হাত ধরেআমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকমতে থাকে।তাই টাকার মানঅবমূল্যায়ন করে পরিস্থিতিসামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেবাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারেরবিপরীতে টাকার প্রায় ৩০শতাংশ অবমূল্যায়নের ফলে আমদানিকরা পণ্যের দামওবেড়ে গেছে।প্রায় একই হারেআমদানি শুল্কও বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রেএই শুল্কের হারকিছুটা কমালেও সার্বিকভাবে আমদানিকরা পণ্যের দামবাড়ন্তই রয়ে গেছে। এইপরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যকেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারবেশ কিছু প্রশাসনিকউদ্যোগ নিয়েছে। আমদানিরওপর নিশ্চয়ই এসবেরপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদেরআমদানি করা নিত্যব্যবহার্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ওবিলাসপণ্যের সরবরাহ অনেকটাই হ্রাসপেয়েছে। তাইহালে বাণিজ্য ঘাটতিঅনেকটাই কমেছে। এর প্রভাবে আমাদের চলতিহিসাবেরও উন্নতি হয়েছে।যদিও এই উন্নতিরপেছনে অনেক ছোটখাটো আমদানিআনুষ্ঠানিক চলতি হিসাবের বাইরেচলে যাওয়ার কারণেওহতে পারে।কেননা ছায়াবাজারে লেনদেনের চাহিদাএখনো বেশ চাঙ্গাবলেই মনে হচ্ছে। এইমুহূর্তে হুন্ডির বাজার কমকরে হলেও ১৫বিলিয়ন ডলারের কম বলেমনে হচ্ছে না। একারণে আনুষ্ঠানিক প্রবাস আয়কমছে। একইসঙ্গে নিট এফডিআইও বিদেশি সহযোগিতারছাড়সহ আমদানি ঋণ ওরপ্তানি বিল ডিসকাউন্টিংকমে যাওয়ার কারণেআমাদের আর্থিক লেনদেন ভারসাম্যনেতিবাচক হয়ে গেছে। এরপ্রভাব সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যেরওপরও পড়েছে।এটিও এখন নেতিবাচক। এসবেরচাপ রিজার্ভের ওপরপড়ছে। তা দ্রুত ক্ষয় হয়েযাচ্ছে। যদিওআমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারএখনো মন্দ নয়। তবুঅর্থনীতির বাড়ন্ত আকারের কথামনে রাখলে এইক্ষয়ের ধারা নিয়ে তোশঙ্কা হতেই পারে। এইপ্রেক্ষাপটে আমাদের রপ্তানিকারকদের নানাসুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও কেনতাদের রপ্তানি আয় আগেরচেয়ে কম নগদায়নহচ্ছে, তা বোঝারপ্রয়োজন রয়েছে। আনুষ্ঠানিকও অনানুষ্ঠানিক বিনিময়হারের এতটা ফারাকই কিএর জন্য দায়ী? এর ফলে কিএমন ধারণা বদ্ধমূলহয়ে যাচ্ছে যেডলারের দাম আগামীদিনে আরো বাড়বে? তাই পুরোটা দেশেনা আনলেই তাদেরজন্য ভালো, নাকিবাকিতে পণ্য রপ্তানি আয়আগাম নগদায়নে বিদেশিব্যাংক আগ্রহী হচ্ছে না? টাকার অবচিতির ধারা হালেরপ্রবাস আয় কমেযাওয়ার পেছনেও খাটে? নাকিপ্রবাসীদের অনেকেরই আনুষ্ঠানিক কাজেরযথাযথ কাগজপত্র নেই? নাকিরেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান অনেক সূক্ষ্মভাবেসব আমদানি এলসিদেখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছথেকে সহযোগিতা পাচ্ছেনা? তাই তারাছায়াবাজারে গিয়ে ডলারের চাহিদাবাড়াচ্ছে। তাহলেএই চাহিদা কমানোরউপায় কী? মুদ্রানীতিও রাজস্বনীতিকে আরোসংকোচনমূলক করাই কি এইসংকটের অন্যতম একটি উত্তরহতে পারে? এসবপ্রশ্ন না এড়িয়েবরং এসবের ভালোও মন্দ দুইদিক নিয়েই অংশীজনদেরসঙ্গে আলাপের কোনো বিকল্পনেই বলে আমারকাছে মনে হয়। আমদানিনির্ভরশিল্পায়নের সুফল আমরা অনেকদিন ধরেই পেয়েআসছি। কাঁচামাল, মধ্যপণ্য ও যন্ত্রপাতিআমদানি না করাগেলে আমদানি বিকল্পকিংবা রপ্তানি শিল্পই বাসচল রাখা যাবেকী করে? ম্যানুফ্যাকচারিংশিল্পগুলোকে ওবিইউ বা অফশোরব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে আমদানিমূল্য সেটলমেন্ট করার বিশেষসুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকই চালুকরেছিল। কিন্তুকী কারণে বিদেশিব্যাংকগুলোর এ ধারায়স্বল্পকালীন আমদানি ঋণ দিতেঅনীহা তা জানাদরকার। অবিলম্বেবিদেশি ব্যাংকগুলো ও তাদেরপ্রতিনিধিদের নিয়ে নিবিড় আলাপেরপ্রয়োজন রয়েছে। আরবিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করারপাশাপাশি (এরই মধ্যেঅনেকটা দেরি হয়ে গেছে) চলতি হিসাবে বাণিজ্যিকলেনদেন, বিজ্ঞাপনী ব্যয়, চিকিৎসাব্যয়, কার্ড পেমেন্টস কীকরে সহজ ও ‘সিমলেস’ করা যায়, তা এক্ষুনি ভাবতেহবে। তাহলেইএসব লেনদেনের জন্যতারা ছায়াবাজারে যাওয়ারপ্রয়োজন বোধ করবেনা। একটানির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রপ্তানিকারকদেরতাদের রপ্তানি পণ্যের আয়দেশে আনতে হয়। বিভিন্নপয়েন্টে (ব্যাংক, কাস্টমস, ইপিবিইত্যাদি) তাদের রিপোর্ট করতেহয়। একইকথা সার্ভিস রপ্তানিরবেলায় খাটে না। তাদের সে জন্যকর সুবিধা ওঅন্যান্য প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজনরয়েছে। তা না হলেএই আয়ও ছায়াবাজারেচলে যেতে পারে। বিদেশিমুদ্রায় পরিবহন খরচের একটিবড় অংশ আমরানিজেদের জাহাজ চালু করেবাঁচাতে পারতাম। এ বিষয়টির পক্ষে বাংলাদেশব্যাংক প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। নৌপরিবহনমন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টঅন্যান্য অংশীজন সমানতালে সক্রিয়হলে এ ক্ষেত্রেবড় মাপের বিদেশিমুদ্রার সাশ্রয় করা নিশ্চয়ইসম্ভব। বর্তমানেরএই টানাপড়েনের মধ্যেইদিল্লিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ টাকা-রুপি কার্ড ওবিনিময়ের যে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছেতার বাস্তবায়ন দ্রুতকরা হলে ডলারখরচের ওপর চাপবেশ খানিকটা কমানোসম্ভব। এর পাশাপাশি যেসব দেশথেকে বেশি পরিমাণেআমদানি করা হয়তাদের সঙ্গে ‘সোয়াপ’ লাইনচালু করা যেতেপারে। একইভাবেআন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে (যেমন—আইডিবির আইটিএফসি) জ্বালানিতেল আমদানির জন্যবিশেষ সমর্থন লাইন চাওয়াযেতে পারে।এই ব্যবস্থা এখনোচালু আছে, তবেসমকালীন বাস্তবতায় তা আরোজোরদার করার সুযোগ রয়েছে। এইআলোচনার আলোকে আমরা নিচেরপ্রস্তাবগুলো করতে পারি : ১. আমদানিসহ চলতি হিসাবের সাধারণলেনদেন সিমলেস করা। ২. প্রবাসআয়কে আরো নীতিসমর্থন দেওয়া এবং তারলেনদেনে যদি কোনোপ্রতিবন্ধকতা থাকে তা দূরকরা। ৩. যেসব ব্যাংক বিদেশিব্যাংকের দেওয়া স্বল্পকালীন ঋণেআমদানি মূল্য সময়মতো মেটায়নিতাদের চিহ্নিত করা এবংতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। একইসঙ্গে ওই সববিদেশি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গেআলাপ করে সববাধা দূর করারইতিবাচক বার্তা দেওয়া।বিনিময় হার ওআমদানি ঋণপত্র মনিটরিংয়ের চেয়েআমাদের ব্যাংকগুলোর বিদেশি লেনদেন পরিশোধব্যবস্থার ধরন মনিটরিংআরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৪. আমদানি পণ্যের দাম মনিটরিংয়েরনামে ব্যাংকগুলোকে আতঙ্কিতনা করে বরংগাইড করা এবংসাহায্য করা দরকার। যাদেরসাধ্য কম তারাকম ইউপাস ব্যবস্থায়যুক্ত হবে—সেবার্তাটি দিতে হবে। ৫. সেবাখাতের আয়কে কর ছাড়ও অন্যান্য প্রণোদনাদিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমেআনার সুযোগ করেদেওয়া। ৬. সার্ক ফিন্যান্সের আওতায়ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেসম্পাদিত ডলার-রুপির ‘সোয়াপ’ ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্যোগনেওয়া যেতে পারে।৭. আইডিবির মতোবহুজাতীয় সংস্থার সঙ্গে জ্বালানিতেল আমদানির জন্যঅন্তত দুই বিলিয়নডলারের বিশেষ ঋণের লাইনখোলা। এ জন্য সৌদি আরবেরসঙ্গে আলাপ করা যেতেপারে। ৮. যেসব ব্যাংকের মূলধনঘাটতি
|