শিরোনাম: |
‘পর্যটন শিল্পে দেশের নৌ-পথ বা লঞ্চ যাত্রা হতে পারে অন্যতম আকর্ষণ’-সাইফুল ইসলাম মিঠু
|
নদী বিধৌত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ একটা সময়ে লঞ্চের মাধ্যমেই যাতায়াত করতেন। বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ার দরুন বৃহৎ একটা অংশ সড়কপথে যাতায়াত করেন। বিশেষ করে বরিশাল এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষ। সেতু ও সড়কপথ হওয়ার পরে কত মানুষ যে লঞ্চের হয়রানি থেকে মুক্ত হয়েছেন, সেটা একটা জরিপ করলে ফুটে উঠবে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের একচেটিয়া ব্যবসা আজকের বাস্তবতায় নতুন কিছু না। যুগের পর যুগ এভাবেই একচেটিয়া ব্যবসা করে কতভাবে যে যাত্রীদের এখানে হয়রানির করা হয়, সেগুলো অব্যক্ত। এই যেমন ঈদ এলে এবং শীতে ভাড়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, কেবিনের দাম দু’তিন গুণ হয়ে যাওয়া, লঞ্চ স্টাফদের দখল করে চড়া দামে সিট বিক্রি করা, খাবারের দাম কয়েক গুণ বাইরের তুলনায় বেশি, নানা সময় স্টাফ কর্তৃক যাত্রী হয়রানি করা, যাত্রীদের গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে এহেন কোনো অপরাধ নেই যেগুলো লঞ্চে যাত্রীদের সঙ্গে করা হয় না। যারা কখনও লঞ্চে যাতায়াত করেননি, তাদের কাছে নৌপথে বাড়ি ফেরার বিষয়টি পরিস্কার নাও হতে পারে। কারণ বেশিরভাগ লঞ্চে ডেকে কোনো নির্ধারিত চেয়ার বা আসন থাকে না। ডেক মানে লঞ্চে বিশাল খোলা স্থান। সাধারণত লঞ্চের নিচতলার পুরো অংশ (পেছনে ইঞ্জিন রুম বাদে), দ্বিতীয় তলায় বড় একটি অংশ এবং কোনো কোনো লঞ্চে তৃতীয় তলার একটি খোলা অংশে ডেক থাকে। ডেকে নির্দিষ্ট আসন নেই। এখানে বিছানা করে যাত্রীরা শুয়ে গন্তব্যে যাতায়াত করেন। বেশিরভাগ সময় লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা আগে না গেলে দ্বিতীয় তলার ডেকে ভালো যায়গা পাওয়া যায় না। আর এক ঘণ্টা আগে না গেলে নিচতলা বা তৃতীয় তলার ডেকেও বিছানা বা কাপড় পাতার সুযোগ হয় না। তখন এসব যাত্রী লঞ্চের ছাদে বা দু’পাশে দাঁড়িয়ে থেকে গন্তব্যে পাড়ি দেন। যদিও তাদের ডেকের সমপরিমাণ ভাড়াই গুণতে হয়। ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে উঠে এলেও দক্ষিণাঞ্চলে নিয়মিত যাতায়াতকারী সব যাত্রীই জানেন, সারাবছর কী ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো তুলনামূলক বিলাসবহুল ও অধিক যাত্রী বহন করতে সক্ষম। ঢাকা থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো তুলনামূলক ছোট। তবে এসব লঞ্চ কেবিনের তুলনায় ডেকে বেশি যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। আর বরিশালের লঞ্চগুলো খুবই আধুনিক। এসব লঞ্চে মেডিকেল, সেলুন থেকে শুরু করে নানা সুবিধা চালু আছে। এখানে ডেকের মতোই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে অনেক যাত্রী ধারণ করতে পারে। আছে ভিআইপি ও ভিভিআইপি কেবিন। ইলিশের মৌসুমে লঞ্চের নিচতলায় একটি বড় অংশ মাছের ঝুড়িতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে। আবার ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার সময় মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণে আলু ওঠে লঞ্চের নিচতলা ও আন্ডারগ্রাউন্ডে। ফলে যাত্রীদের ডেকে আসন সংকট তৈরি হয়। ছাদে যাত্রী পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও প্রতিদিন ঢাকা সদরঘাটে গেলে দেখা যাবে প্রায় সব লঞ্চের ছাদই যাত্রীতে ভরপুর। বর্তমান সময়ে নিয়মিত লঞ্চের সংখ্যা ৯০ থেকে ৪০ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) ঢাকা নদীবন্দর সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ২২০টির মতো লঞ্চ তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে আগে নিয়মিত ৯০টি লঞ্চ চলত। এখন সংখ্যাটি ৪০-এ নেমে এসেছে। যাত্রীর অভাবে ১০টির মতো নৌপথ পুরোপুরি এবং অনেকগুলো আংশিক বন্ধ হয়েছে। অথচ দেশের নৌ-পথে লঞ্চ যাত্রা হতে পারতো অন্যতম পর্যটন শিল্প। দেশি-বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ বা প্রথম পছন্দ। দেশে চাহিদার তুলনায় বাস ও ট্রেনের মতো পর্যাপ্ত নৌযান নেই। আর এ কারণেই নির্দিষ্ট দিনে গন্তব্যে পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে নৌযানে চড়তে হয়। যেহেতু লঞ্চে আসনের অগ্রিম টিকেট কোনো বিষয় নেই, সেহেতু যাত্রীরা চলাচল করেন খুবই নির্ভাবনায়। তবে কেবিনের বিষয়টি আলাদা। লঞ্চে সাধারণত ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিন থাকে এবং বাচ্চা পরিবারসহ থাকার ফ্যামিলি কেবিন। সিঙ্গেল কেবিনে অনেক সময় দেখা যায় দু’জনকে যাত্রী হতে (একজনকে ডেকের টিকিট কাটতে হয়)। এখানে বলা যেতে পারে, কোনো সিঙ্গেল কেবিনে একজনের বেশি থাকতে পারবেন না। আর ডাবল কেবিন মানে হলো এক রুমে দু’টি শয্যা বেড। এখানে বলা যেতে পারে, একটি শয্যা খালি থাকবে অর্থাৎ এক রুমে একজনই যাত্রী হতে পারবেন। স্বামী-স্ত্রী ডাবল কেবিনে যেতে চাইলে তাদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে। হয়তো কেবিনে সেটা সিঙ্গেল বা ডাবল যাই হোক মানানো যেতে পারে। কিন্তু যারা লঞ্চের কাঠামো বোঝেন তারা সবাই নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেবেন, নৌপথে একত্রে সবাই কাছাকাছি অবস্থান করে চলাচল করতে হয়। কারণ লঞ্চে মোট যাত্রীর ৮০ শতাংশ ডেকে যাতায়াত করে। আর ২০ শতাংশ কেবিন যাত্রী প্রথম শ্রেণির দূরত্ব নিশ্চিত করে অবস্থান করেন। লঞ্চ জার্নির মতো এতটা আনন্দদায়ক এবং ক্লান্তিহীন জার্নি কি আছে! এখানে এখন প্রয়োজন হয়রানি বন্ধ করা, আধুনিকতার মানে সুযোগ সুবিধা বাড়ানো, যাতায়াতে সময়ের ব্যাপ্তি কমানো, ভাড়া যাত্রীদের সাধ্যের মধ্যে রাখাসহ আনুষঙ্গিক সববিষয় যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে দেখা। সঙ্গে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কমাতে হবে। একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের প্রাপ্ত সেবার বিষয়গুলো ভুলে গেলে চলবে না এবং এর জন্য যথাযথ মন্ত্রণালয় সঠিক এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে খুব দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব হবে। আশা করি বাংলাদেশে লঞ্চ যাত্রা হবে আরও আনন্দদায়ক ও ভালো লাগার অন্যতম মাধ্যম।
|