শিরোনাম: |
এতিম সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব?’ প্রশ্ন শহীদ ফরিদের স্ত্রীর
|
ফরিদ শেখের আড়াই বছর বয়সী মেয়ের মুখে জুটছে না নিয়মিত শিশু খাদ্য। পুলিশের গুলিতে ফরিদের সংসারের সবকিছু ওলট-পালট আজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ফরিদ শেখ। এখন তার পরিবারে শুধুই অন্ধকার। ছোট্ট আড়াই বছরের শিশু ফাতেমা আক্তারকে এতিম করে চলে গেলেন ফরিদ। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ইতি আক্তারের সাথে শ্বশুরবাড়ির টানাপোড়েন শুরু হয়। ইতি আড়াই বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাবার অভাব-অনটনের সংসারে। বাবা ঢাকায় আছে বললে আদরের অবুঝ ফুটফুটে শিশু ফাতেমা আশায় থাকে বাবা সেখান থেকে ‘মজা’ নিয়ে আসবে। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় আবার খেলার জগতে। বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারল না ফাতেমা। যে দিন জানবে বাবার মৃত্যুর কথা, সেদিন তার সামনে চলে আসবে এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে হাসিনার ফ্যাসিস্ট দোসরদের। ফরিদের মৃত্যুর তিন মাস পরেও মা অপেক্ষায় থাকেন ছেলের ফোনের জন্য। আদরের প্রথম ছেলে ফরিদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের সুখবাসপুর গ্রামের মো: সুলতান শেখের বড় ছেলে মো: ফরিদ (৩১)। সাত ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদ ছিলেন মা-বাবার বড় ছেলে। পাঁচ বোনের পর জন্ম নেয়ায় তিনি ছিলেন বিশেষ আদরের। অথচ সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো সবার আগে। ফরিদের বাবা মো: সুলতান শেখ (৭০) বলেন, ‘ফরিদ স্থানীয় বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশোনা বেশি করতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন হিমাগারে কাজ করায় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোনো কাজ করতে পারি না। সংসারে হাল ধরতে ফরিদ দেড় বছর আগে ঋণ নিয়ে তিন সিঁড়িতে ফোনের দোকান দেয়। ব্যবসায় মার খেয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে সুখ আনতে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে চাচাত ভাই নুরুল আমীনের কলার আড়তে কাজ শুরু করে। ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ফরিদ কাজের ফাঁকে আন্দোলনে চলে যেত। তিনি আরো বলেন, ‘ফরিদ এলাকায় থাকার সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। গত ৪ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে যাত্রবাড়ীতে পুলিশের গুলি তার পেটে বিদ্ধ হলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। আন্দোলনকারীরা স্থানীয় কয়েকটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার চেষ্টা করে। প্রত্যেক ক্লিনিকে আহত রোগীতে ভর্তি থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেনি। পরে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পেটের গুলি বের করতে অপারেশন লাগে। ওই সময় ফরিদের চাচাত ভাই নুরুল আমীন ফোন করে জানায়, ফরিদ গুলি খেয়েছে, হাসপাতালে আছে। দেশে গণ্ডগোল থাকায় ঢাকায় যেতে পারিনি। পর দিন ভোরে ঢাকায় মুগদা হাসপাতালে যাই। দু’দিন হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল ফরিদ। অপারেশনের পরেও আর জ্ঞান ফেরে নাই। গত ৬ আগস্ট হাসপাতালেই মারা যায় সে। ওই দিনই তিন সিঁড়িতে এনে দাফন করা হয়।’ ফরিদের বাবা জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দু’লাখ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। নিহত ফরিদের স্ত্রী ইতি আক্তার (১৯) একমাত্র সন্তান ফাতেমাকে নিয়ে এখন সদর উপজেলার বাংলাবাজারে বাবার বাড়িতে আশ্রয়ে আছেন। ইতি আক্তার বলেন, ‘ফাতেমা বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারল না। এই আফসোস আমি কোথায় রাখি? বাবা ঢাকায় আছে বললে মেয়ে বলে বাবা মজা নিয়ে আসবে? যারা আমার সন্তানকে এতিম করল, আল্লাহ তাদের বিচার করবে। এতিম সন্তানকে নিয়ে এখন আমি কোথায় যাব? শ্বশুরবাড়ির সাথেও সর্ম্পক এখন ভালো নেই। সেখানে যেতে পারছি না। বাবার বাড়িতেই বা কতদিন থাকব। বাবা ফারুখ গাজী মিশুকচালক। বাবার একার উপার্জনে চারজনের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে মেয়েটাকে মানুষ করব কী করে?’ আগামী দিনের অজানা এক চিন্তায় দিশেহারা ইতি আক্তার আরো বলেন, ‘২০ হাজার টাকা শুধু পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামী থেকে শ্বশুর যে দু’লাখ টাকা পেয়েছেন সেখান থেকে কিছুই আমি পাইনি।’ এ সময়ে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখে ইতি বলতে থাকেন, ‘স্বামীর সংসারও করতে পারলাম না, শ্বশুরবাড়িতেও এখন স্থান হচ্ছে না। জীবনের বড় সম্পদ স্বামীকে হারিয়েছি।’ এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন ইতি। ফরিদের মা আলো বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘পাঁচ মেয়ের পর ঘর আলো করে আসে ফরিদ। আদরের সে ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করাইয়া মাইরা ফেলল। দু’দিন হাসপাতালে বেহুঁশ থাইকা কিছু না বইলা মইরা গেল। আমার ছেলেডা আর ফেরত আসবে না। আমি আমার ছেলের খুনির বিচার চাই।’
|