শিরোনাম: |
কেমন ছিলো খিলাফত শাসন ব্যাবস্থা : তৌফিক সুলতান
|
![]() কিংবা তারা আফগানিস্তান বা সৌদি আরব কে খিলাফত রাষ্ট্রের আয়না সরূপ দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে খিলাফত রাষ্ট্র কেমন তা দেখতে হলে আমাদের কে দেখতে হবে হযরত উমার, উসমান, আলী,আবুবকর রাঃ এদের শাসন ব্যবস্থা ও তাদের শাসন কালের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের কি মনে আছে উমর রাঃ এর নেতৃত্বের কথা। মনে না থাকলে সরণ করিয়ে দিচ্ছি, পৃথিবীর শাসকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হজরত ওমর (রা.) যে উপায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন তা ছিল এক কথায় অসাধারণ। তার শাসনাঞ্চলে অপরাধ ছিল না বললেই চলে। দরিদ্রতার হার নেমেছিল শূন্যের কোঠায়। মানুষের নৈতিকতা, সততা ছিল অনন্য। সে শাসনের সোনালি দিনের কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। ওমর (রা.)-এর শাসনকাল পর্যালোচনা করে বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। মাত্র দশ বছরের শাসনে হজরত ওমর (রা.) কী না করেছেন। হজরত ওমর (রা.)-এর মতো একজন শাসকের বড় প্রয়োজন আজকের পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। হে আল্লাহ, পৃথিবীতে আরেকজন ওমর পাঠান। যিনি অন্যায়-জুলুম-অবিচারমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলবেন। যার সততা ও ন্যায়ের কারিশমা দেখে বালা-মুসিবত,যুদ্ধ,জুলম,আজাব-গজব,মহামারী দূর হয়ে যাবে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে শান্তি-শৃঙ্খলা-সুস্থতা বিরাজ করবে। হযরত উমর রাঃ দরিদ্রদের কাছাকাছি থাকার জন্য উমর রাঃ নিজে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার বাড়ি ছিল মাটির তৈরি এবং তিনি প্রতি সন্ধ্যায় জনগণের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য রাস্তায় বের হতেন। উমর বাইতুল মাল নামক রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন।বাইতুল মাল থেকে মুসলিম ও অমুসলিম দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ, এতিম, বিধবা ও অক্ষমদেরকে সহায়তা প্রদান করা হত। বাইতুল মাল পরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময়েও প্রচলিত ছিল। এছাড়াও উমর রাঃ শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। খিলাফত শাসন ব্যাবস্থার গল্প গুলো বর্তমান সময়ে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয়। এই ধরনের দৃষ্টান্তমূলক হৃদয় বিদারক গল্প গুলো ইসলাম যুগের খিলাফত শাসন ব্যবস্থায় তৈরি হয়ে ছিলো। যা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে মানুষের হৃদয়ে। এমনই একটি ঘটনা হলো : একরাতে নৈশভ্রমণে বের হয়েছেন খলিফা। মূলত এ ভ্রমণে তিনি রাজ্যের নাগরিকের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিতেন। সে রাতে ছিল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দূর যেতেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা গেলেও অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সামনের দিকে এগোতে হলো। বেশ কিছু বালুময় বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার পর কান্নার আওয়াজ আসা স্থানটি নির্ণয় করা গেল। দেখা গেল নিভুনিভু আগুনের চিহ্ন। আরও কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করার চেষ্টা করছেন খলিফা ও তার সঙ্গী। প্রথম বোঝা গেল এক মহিলা চুলায় কিছু রান্না করছেন। তার পাশে দুই শিশু খাবারের জন্য কান্না করছে। অথচ মহিলাটি বাচ্চাদের অতিশিগগিরই (শীগ্রই/দ্রুত) খাবার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বেশকিছু সময় অতিবাহিত হলো। তারা দুজন ঠায় দাঁড়িয়ে এসব চিত্র দেখে যাচ্ছেন। এসব চিত্র দেখার ফাঁকেফাঁকে তারা নিজেদের মধ্যে কিছু ছোট ছোট আলাপও করছেন। এরই মধ্যে তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হলো বিষয়টি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাচ্চাদের দেওয়া মহিলার স্বল্প সময়ের আশ্বাস ফুরাচ্ছে না। তখন তারা আগন্তুক হিসেবে মহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন। একজন আগন্তুকের বয়স খানিকটা বেশি হলেও অপরজন ছিল যুবক। আগন্তুকরা জিজ্ঞেস করল বাচ্চাদের এভাবে কান্নার প্রকৃত কারণ কী? তখন মহিলা অত্যন্ত অসহায়তার সঙ্গে বলতে লাগলেন, এই দুই বাচ্চা আমার সন্তান, আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমি সারা দিন চেষ্টা করেও তাদের জন্য কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পাতিলের মধ্যে পাথর সিদ্ধ করছি এবং অপেক্ষা করছি কখন তারা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন আগন্তুকদের মধ্যে প্রথমজন খুব মর্মাহত হলেন এবং পাশের যুবকে নিয়ে তাদের খাবারের জন্য খলিফা নিজ কাঁধে করে আটা এবং খেজুর নিয়ে আসলেন।এর অল্প সময় পরই মহিলা জানতে পারলেন তার জন্য খাদ্য বহন করে নিয়ে আসা ব্যক্তিই খলিফা। খিলাফত আসলে কী? খিলাফত (আরবি: خلافة khilāfa, উত্তরাধিকার ) হল ইসলামি সরকার ব্যবস্থা, যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নবি ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে খেলাফতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফা সাহাবি আবু বকর রাঃ নির্বাচিত হন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে রাশিদুন খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর সাহাবি মুয়াবিয়া কর্তৃক উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয়। উমাইয়া খিলাফতের পর আব্বাসীয় খিলাফত ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হয়। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণে খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয় ও খেলাফত বিলুপ্ত হয়। মিশরের মামলুক শাসকদের দ্বারা পুনরায় আব্বাসীয় খেলাফত পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৫১৭ উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে মিশরের আব্বাসী খলিফা কর্তৃক খেলাফত হস্তান্তরিত হলে উসমানীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়।যদিও প্রথম মুরাদ (১৩৬২-১৩৮৯) সালে মামলুক সালতানাতের বৈধ দাবিদার না থাকায় খিলাফাতের দাবি করে। ১৯০৯ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লব এর মাধ্যমে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ অপসারণ এবং ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিত্র বাহিনী ও আরব বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদীদের হাতে উসমানী খেলাফত বিলুপ্তির মুখে পড়ে। ১৯২৪ সালে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে নির্বাসিত করে কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত বিলুপ্ত করে। কুরআনে নবি দাউদ (আঃ)কে খিলাফত দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "হে দাউদ , নিশ্চয় আমি তোমাকে জমিনে খলিফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো, আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য কঠিন আজাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল।" — কুরআন ৩৮:২৬ খলিফা হওয়ার শর্তগুলোর প্রধান কয়েকটি হলো: ১। মুসলিম হওয়া ২। প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া ৩। পুরুষ হওয়া ৪। স্বাধীন হওয়া ৫। ন্যায়পরায়ণ হওয়া ৬। বিবেকসম্পন্ন হওয়া ৭। জ্ঞান (ইলম) থাকা ৮। উম্মাহ দরদী ও কাফেরদের সাথে আপোষহীন। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পদ্ধতি : ১। শূরা পরিষদের পরামর্শের ভিত্তিতে নিযুক্ত হওয়া ২। পূর্বের খলিফার একক সিদ্ধান্তে নিযুক্ত হওয়া যেসব কারণে খলিফাকে অপসারণ করা হয়: ১। কুফরী করলে বা ইসলাম পরিত্যাগ করলে সালাত পরিত্যাগ করলে বা সালাতের প্রতি আহ্বান পরিত্যাগ করলে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন না করলে বিবেকবুদ্ধি লোপ পেলে বা শারীরিকভাবে অক্ষম হলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা খলিফাকে অপসারণ করে নতুন খলিফা নিযুক্ত করবেন। ২। বিদ্রোহ সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মাধ্যমে বিদ্রোহ করা ইসলামে বৈধ যদি সামর্থ থাকে, কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। খিলাফত শাসন ব্যবস্থা যেমন সুন্দর এর শাসনকলও তেমনই চমৎকার। আমরা খিলাফত শাসন কাল পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারি কেমন ছিলো এর সৌন্দর্য। হযরত উমর ফারুক (রা.) ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর মানবীয় গুণটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে । তিনি সত্য ও অসত্যের বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ থাকতেন । তিনি রাষ্ট্রের সকল অধিবাসীর খোঁজ- খবর রাখার জন্য পুলিশ বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন । সেনাবাহিনীকে সুশৃঙ্খল করার জন্য প্রতি চার মাস পর বাধ্যতামূলক ছুটির ব্যবস্থা করেন । কৃষি কাজের উন্নয়নে খাল খননের ব্যবস্থা করেন । জনসাধারণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি রাতের অন্ধকারে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াতেন । ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে নিজ কাঁধে করে আটার বস্তা নিয়ে তিনি তাঁবুতে দিয়ে আসেন । স্বীয় স্ত্রী উম্মে কুলসুমকে, প্রসব বেদনায় কাতর এক বেদুইনের স্ত্রীকে সাহায্য করার জন্য তার ঘরে নিয়ে যান । পৃথিবীর রাজা বাদশাহদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন প্রজাবৎসল শাসক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । মানব দরদি হযরত উমর ফারুক (রা.) ছিলেন সাম্য ও মানবতাবোধের মহান আদর্শ । জুমুআর সময় তিনি জনসাধারণের জন্য শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ব্যবস্থা করেন । এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক লোক স্বয়ং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, বাইতুলমাল থেকে প্রাপ্ত কাপড় দিয়ে কারও পুরো একটি জামা হয়নি। অথচ খলিফার গায়ে সে কাপড়ের একটি পুরো জামা দেখা যাচ্ছে । খলিফা অতিরিক্ত কাপড় কোথায় পেলেন? খলিফার পক্ষ থেকে তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ (রা.) উত্তর দিলেন যে, আমি আমার অংশটুকু আমার আব্বাকে দিয়ে দিয়েছি, এতে তাঁর পুরো জামা হয়েছে । আমাদের দেশেও যদি শাসনকার্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় তাহলে আমাদের শাসনকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণও হযরত উমরের মতো ন্যায়পরায়ণ হবেন । খিলাফত শাসন ব্যবস্থার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অন্য একটি হলো: খিলাফত শাসন ব্যবস্থার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে খলিফা হারুন অর রশীদের শাসনামলে সিরিয়ার রাকা শহরের বিচারক অসুস্থ থাকায় নতুন বিচারকের ব্যবস্থা করলেন। দিন কয়েক যেতেই প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামি হিসেবে দরবারে হাজির করলেন। বৃদ্ধা শহরের এক রেস্তোরাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। বিচারে বৃদ্ধা স্বীকার করলেন তিনি গত এক সপ্তাহ যাবত অভুক্ত ছিলেন। তার সঙ্গে থাকা এতিম দুই নাতিও না খেয়ে ছিল। ওদের ক্ষুধার্ত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে না পেরেই তিনি চুরি করেছিলেন। বৃদ্ধার কথা শুনে বিচারক পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। ঘোষণা দিলেন, কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশপ্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন। সবার সামনে রায় দেওয়া হবে। পর দিন সকালে সবার উপস্থিতিতে বিচারক রায় ঘোষণা করলেন ‘বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদন্ড দেওয়া নির্দেশ দেওয়া হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো। বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ওই বৃদ্ধা মহিলার পাশে দাঁড়ালেন। বিচারক বললেন, যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয় সেখানে সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হোক। আদেশ অনুযায়ী বিচারকের হাতে ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করেন। এরপর বিচারক বললেন ‘যে শহরে নগরপ্রধান, খাদ্যগুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাবগ্রস্ত মহিলার ভরণ-পোষণ করতে পারেন না। সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমানভাবে তাদের মারা হোক। ’ এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের ওপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘যে সমাজ একজন বৃদ্ধমহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো। ’ এবার মোট ৫০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রা থেকে ১০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানাবাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধাকে দিয়ে বললেন ‘এগুলো আপনার ভরণ-পোষণের জন্য। আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন অর রশীদের দরবারে আসবেন। খলিফা হারুন অর রশীদ আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। ’ এক মাস পরে বৃদ্ধা খলিফার দরবারে গিয়ে দেখেন; খলিফার আসনে বসা সেই লোকটিই বিচারক। খলিফা চেয়ার থেকে নেমে এসে বললেন, আপনাকে ও আপনার এতিম দুই নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম। আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলিফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। প্রজাদের সাথে খিলাফত রাষ্ট্রের খলিফার আচরণ এই রুপ যা মানুষের হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে ভালোবাসার জোয়ারে বাসিয়ে দেয় অশ্রুর ফোটা। খিলাফত হলে এমন এক শাসন ব্যাবস্থা যেই শাসন ব্যাবস্থার মাধ্যমে খলিফা হারুনর রশীদের মতো খলিফার তৈরি হয়। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাই হচ্ছে খিলাফত রাষ্ট্র। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। সুতরাং, যদি কোন মুসলিম রাষ্ট্রে একজন খলীফাকে বৈধভাবে বাই’আত দেয়া হয় এবং পৃথিবীর কোন স্থানে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য আরেকটি খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ রাসূল (সা) বলেছেন, “যদি দুইজন খলীফার জন্য বাই’আত নেয়া হয়, তবে দ্বিতীয় জনকে হত্যা কর।” (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩) বস্তুতঃ ইসলামী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে শারী’আহ্ আইনকানুন ও বিধিবিধান সমূহ বাস্তবায়ন করা এবং সেইসাথে, ইসলামের আহবানকে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করার লক্ষ্যেই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে মানুষকে পরিচিত করিয়ে, তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দিকে আহ্বান করে এবং সেইসাথে, আল্লাহ্’র রাস্তায় জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামের সুমহান বাণীকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। খিলাফতকে আবার ইমামাহ্ বা ইমারাতুল মু’মিনীনও (বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব) বলা হয়। এটি ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার অস্থায়ী একটি পদ, পরকালের সাথে এ পদ সম্পর্কিত নয়। মানুষের মাঝে ইসলামকে বাস্তবায়ন করা এবং ইসলামের দাওয়াতকে বিস্তৃত করার জন্যই খিলাফত রাষ্ট্রের প্রয়োজন। তাই, এটি অবশ্যই নব্যুয়তের চেয়ে আলাদা। নব্যুয়ত হল একটি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পদ। এটি আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। অপরদিকে খিলাফত হল একটি মানবীয় পদ; যেখানে মুসলিমরা যাকে ইচ্ছা তাকে বাই’আত দিতে পারে এবং মুসলিমদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে নির্বাচিত করে খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করতে পারে। আমাদের নবী মুহম্মদ (সা) একজন শাসক ছিলেন যিনি আল্লাহ্ প্রদত্ত শারী’আহ্’কে বাস্তবায়ন করেছিলেন। সুতরাং, একদিকে তিনি যেমন নবী ও আল্লাহ্’র রাসূল ছিলেন, সেইসাথে তিনি (সা) আল্লাহ্’র বিধানকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে রিসালাতের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শাসনকার্য পরিচালনা করারও দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন: “এবং তাদের মধ্যে ফায়সালা করুন যা আল্লাহ্ অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে” [সূরা মায়িদাহ্: ৪৯] তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন: “আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যতা সহকারে তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন আল্লাহ্ তোমাকে যে সত্য পথ দেখিয়েছেন, সে অনুসারে মানুষের মাঝে তুমি বিচার- ফায়সালা করতে পার”। [সূরা নিসা : ১০৫] আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন, “হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ হতে তোমার প্রতি যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা লোকদের নিকট পৌছিয়ে দাও।” [সূরা মায়িদাহ্: ৬৭] “আর এ কুর’আন আমার নিকট ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে; যেন আমি তোমাদের ও যাদের নিকট এটা পৌঁছাবে তাদের সকলকে সতর্ক ও সাবধান করে দেই।” [সূরা আনআম: ১৯] “হে কম্বল আবৃতকারী! উঠো এবং সতর্ক কর।” [সূরা মুদ্দাস্সির : ১-২] সুতরাং, উপরোক্ত দলিল-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রাসূল (সা) দুটি পদের অধিকারী ছিলেন। একটি হল নবুয়্যত ও রিসালাতের পদ এবং অপরটি হল, মুসলিমদের নেতা হিসাবে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ্’র নাযিলকৃত শারী’আহ্ বিধানসমূহ বাস্তবায়নের পদ। তবে রাসূল (সা) এর পর যারা খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা শুধুমাত্র মানুষ ছিলেন; অর্থাৎ, এদের কেউই রাসূল ছিলেন না। সুতরাং, এটা সম্ভব যে, এই সমস্ত খলীফারা অন্য মানুষদের মতোই ভুলভ্রান্ত চিন্তা করতে পারেন কিংবা, অন্যমনস্ক, অমনোযোগী বা গুণাহ্’র কাজে লিপ্ত হতে পারেন ইত্যাদি। কারণ, তারা ছিলেন মানুষ। তাই, মানুষ হিসাবে তারা কেউই ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। রাসূল (সা) আমাদের বলে গেছেন যে, ইমামগণ ভুল করতে পারেন কিংবা এমন কোন কাজও করতে পারেন যার জন্য জনগণ তাদের ঘৃণা করতে পারে বা অভিশাপ দিতে পারে, যেমন: তিনি অত্যাচারী হতে পারেন, (আল্লাহ্’র প্রতি) অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পারেন ইত্যাদি। তিনি আরও বলেছেন যে, ইমামগণ প্রকাশ্যে কুফরীতেও লিপ্ত হতে পারেন। আবু হুরাইরা (রা) রেওয়ায়াতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “অবশ্যই ইমামগণ ঢালস্বরূপ যার পেছনে থেকে লোকেরা যুদ্ধ করে ও নিজেদের রক্ষা করে। সুতরাং তিনি যদি তাকওয়া অবলম্বন করবার আদেশ দেন এবং ন্যায়বিচারক হন তাহলে তিনি এ সমস্ত কাজের সমপরিমাণ পুরস্কার পাবেন। আর, যদি তিনি তার এর বিরুদ্ধে কিছু করেন তবে তিনি সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। ”(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-২৯৫৭) এর অর্থ হল, ইমামগণ আল্লাহ্’কে ভয় না করে অন্য কোন হুকুম দিতে পারেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আমার পরে স্বার্থপরতা এবং এমন ঘটনা ঘটতে পারে যা তোমরা ঘৃণা করবে। সাহাবীগণ তখন বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের মধ্য হতে যারা ঐ ঘটনাগুলোর সাক্ষী হবে, তাদের আপনি কি করার আদেশ দেবেন?’ তিনি (সা) তখন বললেন, ‘তোমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত তোমাদের অধিকার চাইবে।” (সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫২) জুনাদা বিন আবু উমাইয়া হতে ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমরা উবাদা বিন আস সামিতকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গেলাম এবং তাকে বললাম আল্লাহ্ তোমাকে পথ প্রদর্শন করুন! রাসূল (সা) এর কাছ থেকে শোনা একটি হাদীস আমাদের শোনাও যার মাধ্যমে তুমি উপকৃত হবে। তিনি বললেন: ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাই’আত দিলাম। তিনি আমাদের কাছে যে ব্যাপারে বাই’আত গ্রহণ করেছেন সে ব্যাপারে বললেন যে, আমরা তাঁকে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি কিংবা সুসময় ও দুঃসময় উভয় অবস্থায় তাঁর আদেশ শ্রবণ ও তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উপর যারা কর্তৃত্বশীল তাদের সাথে কোন বিবাদ করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের প্রকাশ্যে কুফরে লিপ্ত হতে দেখি, যে ব্যাপারে আমাদের কাছে আল্লাহ্ পক্ষ হতে শক্তিশালী দলীল রয়েছে।’ (সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫৫) আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসূল (সা) বলেছেন, “যতটা সম্ভব মুসলিমদের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দেবে। সুতরাং, যদি সম্ভব হয় তাহলে আসামীকে মুক্ত করে দাও; কেননা শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে ইমামদের ভুল করার চেয়ে ক্ষমা করার ক্ষেত্রে ভুল করা অধিকতর ভাল।” (সূনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১৪২৪) সুতরাং, এইসব হাদীস এটাই প্রমাণ করে যে, ইমামদের পক্ষে ভুল করা, অমনোযোগী বা গুণাহের কাজে লিপ্ত হওয়া সম্ভব। এ সবকিছুর পরও রাসূল (সা) তাকে মান্য করার নির্দেশ দিয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ইসলাম দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন এবং প্রকাশ্যে কুফরী থেকে বিরত থাকছেন ও গুণাহ্’র কাজে লিপ্ত হবার নির্দেশ না দিচ্ছেন। সুতরাং, রাসূল (সা) এর পর যে সব খলীফা এসেছেন তারা সঠিক ও ভুল দুটোই করেছেন এবং তারা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কারণ, তারা শুধু মানুষ ছিলেন, নবী ছিলেন না। সুতরাং, এটা বলা ভুল হবে যে খিলাফত একটি আধ্যাত্মিক রাষ্ট্র।বরং, এটা একটি মানবীয় রাষ্ট্র, যেখানে মুসলিমরা খলীফাকে ইসলামী শারী’আহ্’র বিধিবিধান সমূহ বাস্তবায়নের জন্য বাই’আত দিয়ে থাকে। ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় খিলাফত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে। |