শিরোনাম: |
জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: পথ ও প্রতিবন্ধকতা
|
![]() ডিজিটাল কার্যক্রম বলতে বোঝায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT)-নির্ভর এমন সব উদ্যোগ, যা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস, জনসচেতনতা এবং উপযুক্ত সমাধান প্রদানে সহায়ক। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (IPCC) অনুসারে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, যেখানে বছরে গড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ জলবায়ুজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বাস্তবতায়, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি—অর্থাৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার ও দক্ষতা অর্জন—জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়, তবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন কৃষক, জেলে, নারী ও উপকূলীয় বাসিন্দারা মোবাইল ফোন, SMS, অ্যাপ্লিকেশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আবহাওয়া পূর্বাভাস, দুর্যোগ সতর্কতা, কৃষি ও মৎস্য সংক্রান্ত তথ্য এবং জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির বিষয়ে সময়মতো জানতে ও প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। "Access to Information (a2i)" বাংলাদেশের সরকারের একটি ডিজিটাল উদ্ভাবনী কর্মসূচি, যার মাধ্যমে সরকারি সেবাগুলো সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। a2i-এর অধীনে "Krishi Call Center", "Digital Krishok Diary", এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ডিজিটাল মডেলিং সিস্টেম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। UNDP-এর সহায়তায় স্থানীয় উদ্ভাবকেরা তৈরি করছে IoT-ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা—যেখানে Internet of Things (IoT) প্রযুক্তির মাধ্যমে জমিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়, প্রয়োজন অনুযায়ী এবং পানির অপচয় না ঘটিয়েই। একইভাবে, BRAC-এর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট অ্যাপস এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগগুলো ইতোমধ্যেই জলবায়ু অভিযোজনের কার্যকর উদাহরণ স্থাপন করেছে। GIS প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূ-উপগ্রহ চিত্র ও অন্যান্য ভৌগলিক তথ্য বিশ্লেষণ করে নদীভাঙন, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধির ধরণ চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। এতে করে আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হচ্ছে। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি ডিজিটাল উদ্যোগ বাস্তবায়নে কিছু বাস্তব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৪৫% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না (BTRC, 2023), এবং গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৫% পরিবারের স্মার্টফোন আছে। নারীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়াও, ডিজিটাল লিটারেসির অভাব, স্থানীয় ভাষায় কনটেন্টের ঘাটতি, এবং তথ্য নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার ঝুঁকি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির পথে বড় বাধা। অনেক সময় প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সাধারণ জনগণের জন্য সহজবোধ্য হয় না, ফলে সেগুলোর প্রভাব সীমিত থেকে যায়। ডিজিটাল কার্যক্রমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ই-শিক্ষা ও ডিজিটাল সচেতনতা। ভিডিও কনটেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন, অনলাইন কোর্স ও ই-ভলান্টিয়ার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তরুণ সমাজ, নারী এবং সাধারণ জনগণকে জলবায়ু বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গড়ে তুলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা, ডিজিটাল গল্প বলা (digital storytelling), এবং ভার্চুয়াল ক্যাম্পেইন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যুব সংগঠনগুলো এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। জীবাশ্ব জ্বালানি পরিহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে স্মার্ট গ্রিড, স্মার্ট মিটারিং ও IoT প্রযুক্তির ব্যবহারে অগ্রগতি হচ্ছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপর নজরদারি এবং অপচয় রোধে এই প্রযুক্তিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রিয়েল টাইমে বিদ্যুৎ ব্যবহারের তথ্য দেখা ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, জলবায়ু অভিযোজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি যেমন; গ্রামীণ এলাকায় টেকসই ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, নারী ও তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার প্রসান, স্থানীয় ভাষা ও প্রেক্ষাপটে কনটেন্ট তৈরি, কমিউনিটি-ভিত্তিক ডিজিটাল উদ্ভাবন উৎসাহিত করা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার সমন্বয়। সর্বদিক বিবেজনা করে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বহুমাত্রিক সংকট মোকাবেলায় প্রযুক্তিনির্ভর, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক ডিজিটাল কার্যক্রমই আগামী দিনে টেকসই অভিযোজন নিশ্চিত করতে পারে।
|